Welcome to my Blog

Friday 28 June 2013

লোকসংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথ/Robindranath

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


               পরাধীন ভারতবর্ষের শিক্ষিত ভদ্রশ্রেণি দেশের বৃহত্তম লোকসমাজ থেকে ক্রমেই দুরে সরে এলেন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটলেও দেশ তাদের কাছে অপরিচিতই রয়ে গেল এত দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতার ফলে দেশের মধ্যে যে ব্যাপক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য দেখা দিল, নিজস্ব সম্পদের প্রতি মমত্ববোধের যে অভাব ও উপেক্ষা দেখা দিল, - রবীন্দ্রনাথই প্রথম সচেতনভাবে তা প্রকাশ করলেন রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি ঘটেছিল, কেন না দেশ ও সমাজকে তিনি দূর থেকে দেখেন নি, দেখেছিলেন মর্মমূলে প্রবেশ করে রবীন্দ্রনাথ বাংলার গ্রামীণ লোকজীবনকে অন্তরঙ্গভাবে জানতেন এই গ্রাম সমাজকেই তিনি ভালোবেসেছিলেন, কেন না দেশ অর্থে তিনি বুঝেছিলেন গ্রামীণ ভারতবর্ষকে, আর দেশবাসী বলতে বুঝেছিলেন এইসব নিরক্ষর দৈবনির্ভর অন্নহীন, স্বাস্থ্যহীন গ্রমবাসীকে ঘনিষ্ঠ সাহচার্য ও মানবিক বেদনাবোধ থেকেই এই ভালোবাসা জন্মেছিল রবীন্দ্রনাথ গ্রামসমাজকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, ভালোবেসেছেন, - আর সঙ্গত কারণেই সেই গ্রামীণ লোকসমাজের সংস্কৃতিকেও আপন ঐতিহ্যের মধ্যে গ্রহণ করেছেন

                 লোকসাহিত্যের ঢিলেঢালা উন্মুক্ত উদার প্রান্তে রবীন্দ্রনাথ বিচরণ করেছেন মহৎ চিরায়ত সাহিত্য কোনো অবস্থাতেই লোক-এতিহ্যকে অস্বীকার করতে পারে না রবীন্দ্রসাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয় রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, লোকসাহিত্যের মতো স্বদেশি জিনিস আর নেই তাঁর বিপুল সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে আমরা লোক-ঐতিহ্যের অসংখ্য উপাদান লক্ষ্য করি রবীন্দ্রনাথের লেখা 'বালক ' কবিতায় কবি তাঁর ছেলেবেলার মানসিকতা প্রকাশ করেছেন লোকসাহিত্যের ভাবনাই এর মধ্যে বিবৃত হয়েছে 'রাজপুত্তুর ' -এ লিখেছেন পৃথিবীতে আর সকলে টাকা খুঁজছে, নাম খুঁজছে, আরাম খুঁজছে - আর, যে আমাদের রাজপুত্তুর সে দৈত্যপুরী থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে বেরিয়েছে তুফান উঠল, নৌকো মিলল না, তবু সে পথ খুঁজছে এটিই হচ্ছে মানুষের সব গোড়াকার রূপকথা আর সবশেষের পৃথিবীতে যারা নতুন জন্মেছে দিদিমার কাছ থেকে তাদের এই চিরকালের খবরটি পাওয়া চাই যে, রাজকন্যা বন্দিনি, সমুদ্র দুর্গম, দৈত্য দুর্জয়, আর ছোট্ট রাজকুমার একলা দাঁড়িয়ে পণ করছে -'বন্দিনিকে উদ্ধার করে আনব ' 'ছিন্নপত্রাবলী 'র ১৮০ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলার এই অনুভুতির কথা আবার প্রকাশ করেছেন ' জ্যোৎস্নারাতে যখন চরে বেড়ান তখন তিনকড়ি দাসীর কথা তাঁর মনে পড়ে ' ১২৯০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসের  ভারতী পত্রিকায় 'বাউলের গান ' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন লোকসাহিত্য সম্পর্কে সচেতনভাবে লেখা রবীন্দ্রনাথের এটিই প্রথম প্রবন্ধ সন্ধ্যাসংগীত-এর ঠিক পরেই প্রভাতসংগীত রচনাকালে কবি যখন নিজের স্বাতন্ত্র ও কাব্যভাষা খুঁজে পেয়েছেন, এই লেখাটি সেই সময়ের এই প্রবন্ধে একটি বিষয়ে কবি যে মন্তব্য করেছেন  তা তাঁর পরবর্তীকালের লোকসাহিত্য সংগ্রহ-প্রীতির পূর্বাভাস বলে মনে হয়,- 'বাঙ্গলা ভাব ও ভাবের ভাষা যতই সংগ্রহ করা যাইবে ততই যে আমাদের সাহিত্যের উপকার হইবে তাহাতে আর সন্দেহ নাই ' লোকসাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের এই বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি তাঁকে এই বিশেষ ক্ষেত্রে অমর করে রাখবে  


                রবীন্দ্রনাথ লোকসংস্কৃতির ঐতিহাসিক মূল্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, স্বদেশের চিত্তের পরিচয় লাভ করেছিলেন লোকায়ত সংস্কৃতির মাধ্যমে নিজের সাহিত্যসৃষ্টিতে যেমন লোকজীবনভিত্তিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি লোকসমাজের বিচিত্র ভাবনা ও উপকরণ তাঁর রচনা, বিশেষ করে কবিতা গান ও নাটককে বৈচিত্র্যে ও ঐশ্বর্যে ভরে তুলেছে কবির রচিত সংগীতে লোকসংগীতের সুর ও ভাবের অঙ্গাঙ্গী বন্ধনের কথাও আজ সুবেদিত গাছের শিকড়ের সঙ্গে মাটির যে সম্পর্ক, লোক-ঐতিহ্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছিল সেই সম্পর্ক এই মানসিকতার উত্তরাধিকারী হিসেবে রবীন্দ্রনাথই প্রথম ব্রাত্যজনের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরেছেন

No comments:

Post a Comment

Thanks for your comments. Please visit again.