রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
পরাধীন ভারতবর্ষের শিক্ষিত ভদ্রশ্রেণি দেশের বৃহত্তম লোকসমাজ
থেকে ক্রমেই দুরে সরে এলেন । জাতীয় চেতনার
উন্মেষ ঘটলেও দেশ তাদের কাছে অপরিচিতই রয়ে গেল । এত দূরত্ব
ও বিচ্ছিন্নতার ফলে দেশের মধ্যে যে ব্যাপক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক
বৈষম্য দেখা দিল, নিজস্ব সম্পদের প্রতি মমত্ববোধের যে অভাব ও
উপেক্ষা দেখা দিল, - রবীন্দ্রনাথই প্রথম সচেতনভাবে তা প্রকাশ
করলেন । রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি ঘটেছিল, কেন না দেশ ও সমাজকে তিনি দূর থেকে দেখেন নি, দেখেছিলেন
মর্মমূলে প্রবেশ করে । রবীন্দ্রনাথ
বাংলার গ্রামীণ লোকজীবনকে অন্তরঙ্গভাবে জানতেন । এই গ্রাম
সমাজকেই তিনি ভালোবেসেছিলেন, কেন না দেশ অর্থে তিনি বুঝেছিলেন গ্রামীণ
ভারতবর্ষকে, আর দেশবাসী বলতে বুঝেছিলেন এইসব নিরক্ষর দৈবনির্ভর
অন্নহীন, স্বাস্থ্যহীন গ্রমবাসীকে । ঘনিষ্ঠ
সাহচার্য ও মানবিক বেদনাবোধ থেকেই এই ভালোবাসা জন্মেছিল । রবীন্দ্রনাথ
গ্রামসমাজকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, ভালোবেসেছেন,
- আর সঙ্গত কারণেই সেই গ্রামীণ লোকসমাজের সংস্কৃতিকেও আপন ঐতিহ্যের মধ্যে
গ্রহণ করেছেন ।
লোকসাহিত্যের ঢিলেঢালা উন্মুক্ত
উদার প্রান্তে রবীন্দ্রনাথ বিচরণ করেছেন । মহৎ চিরায়ত
সাহিত্য কোনো অবস্থাতেই লোক-এতিহ্যকে অস্বীকার করতে পারে না । রবীন্দ্রসাহিত্যও
তার ব্যতিক্রম নয় । রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, লোকসাহিত্যের মতো স্বদেশি জিনিস আর নেই । তাঁর বিপুল
সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে আমরা লোক-ঐতিহ্যের অসংখ্য উপাদান লক্ষ্য করি । রবীন্দ্রনাথের
লেখা 'বালক ' কবিতায় কবি তাঁর ছেলেবেলার মানসিকতা প্রকাশ করেছেন
। লোকসাহিত্যের ভাবনাই এর মধ্যে বিবৃত
হয়েছে । 'রাজপুত্তুর ' -এ লিখেছেন পৃথিবীতে আর সকলে টাকা খুঁজছে,
নাম খুঁজছে, আরাম খুঁজছে - আর, যে আমাদের রাজপুত্তুর সে দৈত্যপুরী থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে বেরিয়েছে । তুফান উঠল, নৌকো মিলল না, তবু সে পথ খুঁজছে । এটিই হচ্ছে
মানুষের সব গোড়াকার রূপকথা আর সবশেষের । পৃথিবীতে
যারা নতুন জন্মেছে দিদিমার কাছ থেকে তাদের এই চিরকালের খবরটি পাওয়া চাই যে, রাজকন্যা বন্দিনি, সমুদ্র দুর্গম, দৈত্য দুর্জয়, আর ছোট্ট রাজকুমার একলা দাঁড়িয়ে পণ করছে
-'বন্দিনিকে উদ্ধার করে আনব '। 'ছিন্নপত্রাবলী 'র ১৮০ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলার
এই অনুভুতির কথা আবার প্রকাশ করেছেন । ' জ্যোৎস্নারাতে যখন চরে বেড়ান তখন তিনকড়ি দাসীর কথা তাঁর মনে পড়ে '। ১২৯০ বঙ্গাব্দের
বৈশাখ মাসের ভারতী পত্রিকায় 'বাউলের গান ' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন । লোকসাহিত্য
সম্পর্কে সচেতনভাবে লেখা রবীন্দ্রনাথের এটিই প্রথম প্রবন্ধ । সন্ধ্যাসংগীত-এর
ঠিক পরেই প্রভাতসংগীত রচনাকালে কবি যখন নিজের স্বাতন্ত্র ও কাব্যভাষা খুঁজে পেয়েছেন, এই লেখাটি সেই সময়ের । এই প্রবন্ধে
একটি বিষয়ে কবি যে মন্তব্য করেছেন তা তাঁর
পরবর্তীকালের লোকসাহিত্য সংগ্রহ-প্রীতির পূর্বাভাস বলে মনে হয়,- 'বাঙ্গলা ভাব ও ভাবের ভাষা যতই সংগ্রহ করা যাইবে ততই যে আমাদের সাহিত্যের উপকার
হইবে তাহাতে আর সন্দেহ নাই '। লোকসাহিত্যচর্চার
ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের এই বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি তাঁকে এই বিশেষ ক্ষেত্রে অমর করে রাখবে
।
রবীন্দ্রনাথ
লোকসংস্কৃতির ঐতিহাসিক মূল্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, স্বদেশের চিত্তের
পরিচয় লাভ করেছিলেন লোকায়ত সংস্কৃতির মাধ্যমে । নিজের সাহিত্যসৃষ্টিতে
যেমন লোকজীবনভিত্তিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি লোকসমাজের বিচিত্র ভাবনা ও উপকরণ তাঁর রচনা, বিশেষ
করে কবিতা গান ও নাটককে বৈচিত্র্যে ও ঐশ্বর্যে ভরে তুলেছে । কবির রচিত
সংগীতে লোকসংগীতের সুর ও ভাবের অঙ্গাঙ্গী বন্ধনের কথাও আজ সুবেদিত । গাছের শিকড়ের
সঙ্গে মাটির যে সম্পর্ক, লোক-ঐতিহ্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছিল সেই সম্পর্ক । এই মানসিকতার
উত্তরাধিকারী হিসেবে রবীন্দ্রনাথই প্রথম ব্রাত্যজনের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে
ধরেছেন ।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comments. Please visit again.