মহালয়া |
'মহালয়া ' কথাটির অর্থ কি ? অথবা, পিতৃপক্ষের অবসান লগ্ন বা দেবীপক্ষের পূর্ববর্তী অমাবস্যাকে 'মহালয়া ' বলাহয় কেন ? এই ব্যাপারে নানা
মুনির নানা মত । 'মহ ' শব্দটির দুই অর্থ
পাই । 'মহ ' বলতে বোঝায় পূজা, আবার 'মহ ' বলতে বোঝায় উৎসব । আবার মহালয় বলতে বোঝায় মহান + আলয় = মহালয় । তার সঙ্গে স্ত্রীকারান্ত 'আ ।মহালয় হচ্ছে পূজা বা উৎসবের আলয়
বা আশ্রয় । আলয় শব্দটির একটি অর্থ হচ্ছে আশ্রয় । আন্যদিকে 'মহালয় ' বলতে , 'পিতৃলোককে ' বোঝায় -যোখানে বিদেহী
পিতৃপুরুষ অবস্থান করছেন । তা যদি হয় তাহলে পিতৃলোককে স্মরণের অনুষ্ঠানই মহালয়া । কিন্তু তাহলে স্ত্রীলিঙ্গ হল কেন ? তাহলে পিতৃপক্ষের অবসানে, অন্ধকার অমাবস্যার সীমানা ডিঙিয়ে
আমরা যখন আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনকে প্রত্যক্ষ করি - তখনই সেই মহা লগ্নটি আমাদের জীবনে 'মহালয়ার ' র্ব্তা বহন করে আনে । এক্ষেত্রে স্বয়ং দেবীই হচ্ছে সেই মহান আশ্রয়, তাই উত্তরণের লগ্নটির নাম মহালয়া ।একটি অর্থ অনুসারে মহান আলয়টি হচ্ছে পিতৃলোক । সংবদ্য ও বেদান্ত দর্শন অনুসারে
সমস্ত লোকের মধ্যে পিতৃলোকও একটি । এই পিতৃলোকে পিতৃ, ঋষি ও প্রজাপতিরা বাস করেন । তাঁদের সঙ্গেই পিতৃতর্পণের মাধ্যমে
আমরা মানসিক ও আত্মিক সংযোগ স্থাপন করি, তাঁদেরই প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা
ও প্রণাম নিবেদন করি । আশ্বিন মাসের এই কৃষ্ণপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনায় যে অমাবস্যাকে আমরা মহালয়া
হিসেবে চিহ্নিত করি, সেই দিনটি হচ্ছে পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার সন্ধিলগ্ন । পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার মাধ্যমে
এই দিনটিতে আমরা আমাদের এই মানব জীবনকে মহান করে তুলতে প্রয়াসী হই বলেই এই পূণ্যলগ্নটি
আমাদের জীবনে বারবার মহালয়ারূপেই দেখা দেয় ।
পুজো প্রস্তুতি |
মহালয়া এলেই বাংলার মাটি-নদী-আকাশ
প্রস্তুত হয় মাতৃপূজার মহালগ্নকে বরণ করার জন্য । কাশফুল ফুটলে শরৎ আসে, না,শরৎ এলে কাশফুল ফোটে, অথবা নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা
ভাসলে শরৎ আসে, না, শরৎ এলে নীল আকাশে সাদা মেঘের
ভেলা ভাসে -এসব নিয়ে বিস্তর তর্ক চলতে পারে । কিন্তু মহালয়া এলেই যে দুর্গাপূজা
এসে য়ায় - তা নিয়ে তর্কের কোনও অবকাশ নেই । মহালয়া এলেই সেই দেবী -বন্দনার
সুরে ধ্বনিত হয় বাংলার হৃদয়ে । দূর থেকে ভেসে আসে ঢাকের আওয়াজ । বুকের মধ্যে জাগে আনন্দ-শিহরিত
কাঁপন ; এবার মা আসবেন ।
মহালয়ায় তর্পণ |
অনন্তকাল ধরে এই ভারতভূমির কোটি কোটি
মানুষ মহালয়ার পুণ্যপ্রভাতে - 'ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যান্ত
ভুবনত্রয়ম ' - এই মন্ত্র উচ্চারণ করে তিন গন্ডুষ জল অঞ্জলি দিয়ে স্মরণ করে
চলেছেন তাঁদের বিদেহী পিতৃপুরুষ এবং তাঁদের পূর্বপুরুষকে । এই মহালয়া উপলক্ষেই গয়ায় জমে
ওঠে পিতৃপক্ষের মেলা । ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত ও ভারতের বাইরে থেকে হাজার হাজার পূণ্যার্থী এই সময় গয়ায়
আসেন পিতৃতর্পণ ও পিন্ডদান করতে । পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে গয় নামের এক অসুরের দেহের উপর এই মহাতীর্থ স্থাপিত । তাই এই পূণ্যভূমির নাম গয়াধাম
। বায়ুপুরাণে বলা হয়েছে, যাদের এখানে (গয়ায়) সপিন্ডক শ্রাদ্ধ হবে, তারা ব্রহ্মলোক গমন করুক । সকল দেবতা ও সকল তীর্থ এখানে অবস্থান করুক । কথিত আছে, ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র পিতা দশরথের উদ্দেশ্যে এখানে পিন্ডদান করেণ । দশরথের প্রেতাত্না সীতাদেবীর হাত
থেকে চালের অভাবে বালুকার পিন্ড গ্রহণ করেছিলেন । ফল্গুনদী, তুলসী গাছ ও অক্ষয়বট এই ঘটনার সাক্ষী ছিল । শ্রীরামচন্দ্রেই ঘটনার সত্যতা
যাচাই করতে যখন ফল্গুনদী ও তুলসী গাছকে প্রশ্ন করেন, তখন তারা মিথ্যা কথা বলে । ফলে সীতাদেবী তাদের অভিশাপ দেন । কিন্তু অক্ষয়বট সত্য কথা বলায়, সীতাদেবী তাকে আশীর্বাদ করেন । শুধু রামায়ণে নয়, পিতৃতীর্থ গয়ার মহিমা মহাভারতেও
উল্লিখিত । ভীম পিতা শান্তনুর উদ্দেশ্যে গয়াশিরে পিন্ডদান করলে পিতা তাঁকে ইচ্ছামৃত্যু বর
দিয়েছিলেন । ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও স্বীয় পিতা পান্ডুর উদ্দেশ্যে এখানে পিন্ড দান করলে পিতা তাঁকে
আশীর্বাদ করে বলেন, বৎস, তুমি স্বশরীরে স্বর্গগমন করতে
সমর্থ হবে ।স্মরণীয় ধর্মনিষ্ঠ হিন্দুরা অন্যকোনও
তীর্থে যাবেন কি যাবেন না, সেটা তাঁদের মানসিকতার ব্যপার, কিন্তু পিতৃকার্য করার জন্য সকলকেই অন্তত একবার গয়াতে যেতেই হবে । এটা একটা অবশ্যপালনীয় কর্তব্য
।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comments. Please visit again.