মানুষের শরীরটাই যেন একটা রথ । আমরা
দেখি,
কঠোপনিষদে সেই রথের এক অপূর্ব বর্ণনা । আমাদের
শরীর-রূপ রথখানি বিজয়পথে অবিরাম ছুটে চলেছে । মানবদেহের
ইন্দ্রিয়গুলি হচ্ছে এই রথের ধাবমান ঘোড়া ।
আমাদের
বুদ্ধি-রূপ সারথি, জন-রূপ লাগাম জুড়ে দিয়ে
ইন্দ্রিয়-রূপ ধাবমান ঘোড়াগুলির গতিকে সবলে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে । আর
সেই রথের অধিপতি হচ্ছে আত্মা, যা কিনা অচঞ্চল শান্ত
মূর্তিতে রথোপরি বিরাজিত, রথের গতিবেগ তাঁকে আদৌ স্পর্শ করছে
না । অনেক
পন্ডিত মনে করেন শ্রীশ্রীজগন্নাথকে নিয়ে এই রথযাত্রা উৎসব ওই চিরন্তন আধ্যাত্মিক আদর্শকেই
সর্বজনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এক লৌকিক আয়োজন । জনসমষ্টি
নিয়েই জগৎ এবং সেই জনগণের অধিনায়ক হচ্ছে প্রভু জগন্নাথ । জগন্নাথ
স্বামী "অঙ্গুষ্ঠ মাত্রঃ পুরুষঃ " রূপে সকলের মধ্যে রয়েছেন । অনন্তকালের
এই বিশ্বাস পোষণ করেই ভক্তরা মনি করেন, তাঁকে
জানলে ও বুঝলে আর পুনর্জন্ম হয় না ।
জগন্নাথের রথযাত্রা উৎসব,
যার মধ্যে দেবতা ও মানুষের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক যেমন বিকশিত, তেমনি ভক্ত ও ভগবানের চিরন্তন ভালোবাসার সম্পর্কটিও প্রকাশিত । জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম
এই তিন দেবতা তাদের রত্ন-সিংহাসন থেকে নেমে আসেন পথের ধূলায়,
নেমে আসেন সর্বজনের মাঝে, ধরা দেন শ্রেণীহীন,বর্ণহীন এক বিশাল জনগোষ্ঠির হাতে এবং এভাবেই দেব মহিমায় অভিষিক্ত হয় মানব মহিমা
। পুরীর
রথযাত্রা ভারতীয় ধর্মজীবনের এক অতি প্রাচিন উৎসব । প্রকৃতপক্ষে
পুরীর পরই আমরা মাহেষের বিখ্যাত রথ যাত্রার কথা স্মরণ করতে পারি । এছাড়াও
মহিষাদলের রথযাত্রা, চন্দনদগরের রথযাত্রা এবং
সাম্প্রতিক ইস্কনের রথযাত্রা বা উল্টোডাঙ্গার রাইকানু ভাগবত সমাজের জনপ্রিয় রথযাত্রার
কথাও উল্লেখ করতে পারি ।
এই
তালিকা অনায়াসেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা য়ায় । কারণ,
বাঙালীর জীবনে দোল-দুর্গোৎসব প্রভৃতির মতো রথযাত্রাও বাস্তব অর্থে গণউৎসব
।
আমরা বলে
থাকি জগন্নাথদেবের মন্দির । কিন্তু
প্রকৃতপক্ষে কি তাই ? কারণ, মন্দিরের
রত্নবেদীতে শ্রীশ্রীজগন্নাথ একা অবস্থান করে না । তাঁর সঙ্গে
অবস্থান করেন বলাম, সভুদ্রা ও সুদর্শন চক্র । এক সঙ্গে চারজনেরই পুজো হয় । হিন্দু
ধর্মের চারবর্ণের প্রতিক এই চারজন ।
বলরাম
বা ব্রহ্মভদ্রের গায়ের রং শ্বেতবর্ণ- তিনি ব্রাহ্মণ । দেবী
সুভদ্রার বর্ণ পীত, তিনি ধারণ করেছেন বৈশদের
প্রতীক । শ্রীশ্রীজগন্নাথের
গাত্রবর্ণ গাঢ়নীল বা কালো ।
অথাৎ,
তিনি শূদ্রদের প্রতীক ধারণ করেছেন । আর
রক্তবর্ণ সুদর্শন চক্র ক্ষত্রিয় প্রতীক ।
পুরীধামে
জগন্নাথদেব যে রথে আরেহণ করেন, তাকে বলা হয়
'নান্দীঘোষের রথ ', রথের সারথি মাতলি । শীর্ষদেশে
থাকে একটি চক্র এবং চক্রের উপর দিকে শোভিত থাকে গড়ুর ও একটি বর্ণাঢ্য বিরাট পতাকা । বলরামের
রথের নাম
'তালধ্বজ ',রথের সারথি সুদ্যুন্ম । সুভদ্রার
রথের নাম
'দেবীরথ বা দর্পদলন ',এর সারথি অর্জুন । প্রতি
বছর মাঘ মাসের বসন্ত-পঞ্চমী তিথিতে এই তিনটি রথের জন্য কাঠ সংগ্রহ শুরু হয় । আর
অক্ষয় তৃতীয়ায় রথ তৈরির কাজ শুরু হয় ।
এইভাবে
প্রতিবছর তিনটি রথ তৈরি করা হয় ।
জগন্নাথের এমন অসমাপ্ত রূপ কেন
? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কয়েকটি পৌরাণিক কাহিনীর সন্ধান পাওয়া
য়ায় । সেগুলির
মধ্যে প্রচলিত একটি হল উল্লেখ করা হল ।
সেকালে
মালব দেশের মধ্যবর্তী অবন্তিনগরের রাজা ছিলেন পুন্যবান ইন্দ্রদ্যুম্ন । তিনি
ছিলেন শ্রীবিষ্ণুর পরম ভক্ত ।
ইনিই
পুরীর মন্দির প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন ।
একদিন
রাজা সপ্নাদেশ পেলেন, প্রভাতে পুরীর সমুদ্রতীরে
চক্রতীর্থে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম শোভিত দারুব্রহ্মের সাক্ষাৎ পাওয়া য়াবে । তার
মানে,
সমুদ্রের স্রোতে ভেসে আসবে পবিত্র একটি কাঠ । সমুদ্রে
ভেসে আসা সেই দারুব্রহ্মকে রাজা যেন ভক্তিভরে মন্দিরে নিয়ে আসেন । তবেই
তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হবে ।
যথাসময়ে
রাজা দারুব্রহ্মের সাক্ষাৎ পেলেন এবং তা মন্দিরে নিয়ে এলেন । সেই
সময় হঠাৎই এক বৃদ্ধ শিল্পী এসে রাজদরবারে উপস্থিত হলেন । ইনি
স্বেচ্ছায় মূর্তি তৈরির দায়িত্ব নিতে চান ।
এই
বৃদ্ধ শিল্পীই যে ছদ্মবেশী বিশ্বকর্মা (মতান্তরে স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু )- সেটা রাজা বুঝতে
পারেননি । রাজা
অপরিচিত এই বৃদ্ধ শিল্পীর হাতে মূর্তি তৈরির দায়িত্ব তুলে দিলেন । কিন্তু
বৃদ্ধ শিল্পীর শর্ত মূর্তি তৈরির কাজ শুরু হওয়ার পর একশ দিন অতিক্রম হওয়ার আগে রাজা
ইন্দ্রদ্যুম্ন দরজা খুলতে পারবেন না, এবং শিল্পী
নিজের মনে বন্ধ ঘরে ওই সময় কাজ করবেন ।
রাজা গভীর আগ্রহে বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন
এবং দেখতে দেখতে পনেরদিন অতিক্রন্ত হয়ে গেল । হঠাৎ
রাজা লক্ষ্য করলেন, বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে আর
কোন শব্দ আসছে না ।
তিনি
রীতিমত অধৈর্য হয়ে পড়লেন ।
শেষ
পর্যন্ত মন্ত্রীদের শত অনুরোধ উপেক্ষা করে জোর করে দরজা খুলে মন্দিরে ঢুকে পড়লেন । কিন্তু
কোথায় সেই শিল্পী -তিনি অদৃশ্য । মন্দিরে বিরাজ করছেন তিনটি অসমাপ্ত মূর্তি । এবার
রাজা বুঝলেন, ওই শিল্পী স্বয়ং দেবতা ছিলেন । নিজ
কৃতকর্মের জন্য তিনিঅনুতাপে ভেঙ্গে পড়লেন ।
শেষপর্যন্ত
অপরাধের শাস্তি হিসাবে আত্মবিসর্জনের দৃঢ় সংকল্প নিলেন । সেই
রাতেই তিনি আবার সপ্নাদেশ পেলেন - "আত্মহত্যা মহাপাপ,
এটা তোমাকে মানায় না ।
তুমি
ওই তিনটি অসমাপ্ত বিগ্রহকেই যথা নিয়মে পূজা কর ।" সেই থেকেই অসমাপ্ত রূপে জগন্নাথ,
বলরাম ও সুভদ্রা পুরীতে পূজিত হয়ে আসছেন ।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comments. Please visit again.