রবীন্দ্রনৃত্য |
প্রাচীন ভারতীয় নৃত্যশাস্ত্র গ্রন্থে নাচকে
দু-ভাগে ভাগ করা হয়েছে, একটিকে বলা হয়েছে
'নৃত্য ', অপরটিকে 'নৃত্ত
'। ছন্দময়
দেহভঙ্গির সুষমার সঙ্গে যখন নানা রসের গানের অভিনয় যুক্ত হয়,
তখন তাকে বলে 'নৃত্য ', আর
'নৃত্ত ' হল অভিনয়বিহীন ছন্দময় দেহভঙ্গি । এই
দুটি ধারার নাচ ভারতের সর্বত্রই প্রচলিত ।
'নৃত্য ' ধর্মী নাচের প্রকাশ দেখি কেরলের কথাকলি,
তামিলনাড়ুর ভরতনাট্যম, অন্ধ্রপ্রদেশের কুচ্চিপুড়ি,
কর্ণাটকের যক্ষগণ, উড়িষ্যার ওড়িশি,পশ্চিম ভারতের কথ্থক ও মণিপুরের মহারাস নৃত্যে । এগুলি
পুরোপুরি পেশাদার নাচ ।
এর
জন্য নানা ভাবে অর্থ ব্যয় হয় ।
প্রয়োজন
হয় গুরুর সাহায্য, অভিনয়ের শিক্ষা নিতে হয়
। এছাড়া
প্রয়োজন হয সাজানো-গোছানো মণ্ডপ, মঞ্চপ্রাঙ্গন,
তা সে মন্দিরেই হোক, শহরেই হোক বা গ্রামেই হোক
।
'নৃত্য ' পর্যায়ের নাচে যে সর্বত্রই শাস্ত্রানুযায়ী একই
রীতিতে গঠিত তা নয় ।
অভিনয়
রীতির বৈচিত্র এতেও দেখা য়ায় ।
ভরতনাট্যম,
কথাকলি, কুচ্চিপুড়িতে দেহের সব অঙ্গের সাহায্যে,শাস্ত্রিয় ধারার অনুসরণে, গানের সঙ্গে, নানা ছন্দে যেভাবে অভিনয় করতে হয়, মণিপুরি রাস নৃত্য,
কথ্থক নৃত্য এবং ওড়িশি নাচের রীতি তা থেকে ভিন্ন । তাছাড়া
বিভিন্ন প্রদেশের লোকনাট্যের গানের সঙ্গে অভিনয় হয় সহজ সরল অঙ্গভঙ্গিতে । অভিনয়
বিহীন ছন্দবদ্ধ নাচকে নৃত্যশাস্ত্র বলেছে 'নৃত্ত
'। স্বতন্ত্রভাবে
এইসব নাচ শেখবার কোনো ব্যবস্থা নেই ।
উৎসবে,
পরবে শিশুরা বড়োদের সঙ্গে নাচে যোগদান করে, বড়োদের
নাচের অনুকরণ করতে করতে নাচ শিখে ফেলে । সাজপোশাখে
বিশেষ বৈচিত্র নেই, গ্রামবাসীদের প্রতিদিনের
ব্যবহৃত পরিচ্ছদই এখানে অলংকৃত হয় ।
ভারতের 'নৃত্য ' ও 'নৃত্ত ' দুই ধরনের নাচের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ধরনের নৃত্য প্রচলন করেণ
। শান্তিনিকেতনের
নৃত্যে মণিপুরি রাস-নৃত্যের অনুরূপ অভিনয় যেমন স্থান পেয়েছে,
তেমনই স্থান পেয়েছিল বাংলার ও ভারতীয় বিভিন্ন প্রকৃতির লোকনৃত্যের নানা
ঢং । গানের
ভাব ও রসের সঙ্গে দুই নৃত্যধারাকে সাজিয়ে, প্রয়োজনমতো
এক করে নিয়েছেন ।
রবীন্দ্রনাথের
গানের সঙ্গে যখন দলবদ্ধ নাচ হয়েছে, তখন তার
সঙ্গে অভিনয়ের কথা না ভেবে দলবদ্ধ লোকনৃত্যের আদর্শের আঙ্গিকেই তাকে তৈরি করেছেন । তার
উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল শান্তিনিকেতনের 'বৃক্ষরোপণ
' ও 'বসন্তোৎসব ' -এর
'মরুবিজয়ের কেতন উড়াও ' এবং 'ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল ' গান দুটি । এর
সঙ্গে যে নাচ প্রচলিত, সেটি অনেক ভেবেচিন্তে,
ভারতের দলবদ্ধ লোকনৃত্যের আদর্শকে সামনে রেখে রচনা করা হয়েছিল । ধ্রপদি
নৃত্য যথা ভরতনাট্যম, কথাকলি, মণিপুরি, কথ্থক ও ওড়িশি নাচ যেমন সুশৃঙ্খল নৃত্যপদ্ধতিতে
গাঁথা । সেরূপ
কোনো বাঁধা নিয়মে সুনিদিষ্ট নয় শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারা । সুতরাং
একে অন্যান্য ধ্রুপদি নৃত্যশৈলীর মতো শ্রেণিনদ্ধ করা কখনোই সম্ভব নয় । রবীন্দ্রনাথের
গান ও নৃত্যনাট্যের গানের সঙ্গে যে আঙ্গিকে নৃত্যাভিনয় হয়েছে তা ছিল সর্বদাই পরিবর্তনশীল
। কোনোপ্রকার
নিদিষ্ট নৃত্যধারা এর থেকে গড়ে ওঠেনি ।
প্রতিবারেই
ভিন্ন ভিন্ন নৃত্যভঙ্গির সাহায্যে,
পরীক্ষানিরীক্ষা করে গানের সঙ্গে উৎকৃষ্ট অভিনয়ের জন্য তাকে তৈরি করে
নিয়েছেন। এ
হল চলমান মিশ্র নৃত্যধারার দ্বারা নৃত্যাভিনয় ।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comments. Please visit again.