|
Bishwavarati university |
কবির ভাষায় 'আরম্ভের পূর্বেও আরম্ভ আছে ।সন্ধ্যাবেলার দীপ জ্বালাবার আগে সকালবেলায়
সলতে পাকানো '।
বিশ্বভারতী
বিশেষ কোনো সরকারি আইন
বলে একদিন বিশেষ একটি স্থানে, বিশেষ দেশে,
বিশেষ ব্যক্তি বা বিশেষ নগরীর নামে সৃষ্টি হয়নি । 'বিশ্বভারতী' এই শব্দের দ্বারা কোনো স্থান,ব্যক্তি, সম্প্রদায় বা ধর্ম বোঝায় না -এটি একটি আইডিয়া । এই
আইডিয়া কবির মনে ধীরে ধীরে জন্মায় ।
একদিন
অকস্মাৎ এর আবির্ভাব ঘটেনি ।
'বিশ্বভারতী' স্থাপিত হওয়ার বহু পূর্বে রবীন্দ্রনাথ
তাঁর চল্লিশ বৎসর বয়সে বোলপুরের নিকট তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত
শান্তিনিকেতন আশ্রমে পাঁচ জন কিশোরকে নিয়ে তাঁর 'ব্রহ্মচর্যাশ্রম'
বিদ্যালয় আরম্ভ করেন ।
একটি
তিনকুঠুরির ঘরই ছিল ছাত্র-শিক্ষকের বাসস্থান । এটি
নির্মান করেন কবির ভাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর । তাঁর
ইচ্ছা ছিল, এখানে ব্রহ্মধর্মের আদর্শে একটি বিদ্যাশ্রম
রচনা করা । তাঁর
অকাল মৃত্যুতে তা সম্ভব হয়নি -রবীন্দ্রনাথ বলেন্দ্রনাথের কল্পনাকে নতুন রূপ দান করে
ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন করেন ১৩০৮ সালের ৭ই পৌষ,মহর্ষির ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষার দিন । ব্রহ্মচর্যাশ্রমের
ছাত্র সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ।
বাড়তে
থাকে শিক্ষকও । সমস্যা
হল সাধারণ ব্রহ্মসমাজভুক্ত যাঁরা, তাঁরা জাতপাত মানেন
না । ব্রাহ্মণ
শিক্ষকদের প্রশ্ন, ব্রাহ্মণ ছাত্ররা কী করে
কায়স্থর পদধূলি নেবে ! তাছাড়া ব্রাহ্মণরা কি ভাবে মুসলমান ছাত্রদের সঙ্গে এক আচ্ছাদনের
নীচে খাবে ?
রবীন্দ্রনাথ
ইংল্যান্ডে ও পরে আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ দেখেন, তখন তাঁর মনে বিশ্বভারতীর স্বপ্ন জাগরিত হয়েছিল কি ? তার পর অ্যান্ডরুজ ও পিয়ার্সনের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে কবির জীবনে এবং ওই দুই জন
পাদরির জীবনে যে পরিবর্তন আসে তা বিশ্বমানবতারই দ্যোতক । ইতিমধ্যে
জাতের বেডা ভাঙতে শুরু করেছে । স্কুলের
দুটি ছাত্র একটি মুসলমান অপরটি সাঁওতাল দপ্তরির কাজ শিখছে, বাঁধানোর কাজ শিখছে । তাদের নিয়ে
পৃথক স্থানে ভোজন করছে দুজন স্কুলের ছাত্র । বৃহত্তর
জগতের ঘাতপ্রতিঘাতে কবির মানসলোকে তার প্রতিক্রিয়ার ছবি আঁকা চলছে । প্রথম মহাযুদ্ধ
শুরু হয়েছে, জাতীয়তাবাদের উগ্রমূর্তি দেখা দিয়েছে
দিকে দিকে । জাপান চীনের উপর উপদ্রব শুরু করেছে
সেদিনকার চীনের গৃহযুদ্ধ ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে । কবি আছেন
আমেরিকায় বক্তৃতা শফরে । ন্যাশনালিজমের
উগ্রতার তীব্র সমালোচনা করে বক্তৃতা দিলেন জাপানে ও আমেরিকায়
। ভারতে
কবি হলেন রাজনৈতিক নিন্দার পাত্র ।
ন্যাশনালিজম
যে বিশ্বশক্তির শেষকথা নয় - এ কথা কবি স্পষ্ট করে ঘোষনা করলেন । Interdependence হচ্ছে সভ্যতার মৌল কথা ।
১৯১৬ সালে কবি
আমেরিকায় একাই গিয়েছেন বক্তৃতা শফরে । সেখান থেকে রথীন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতনে যে পত্র লেখেন তিতে
আমরা বিশ্বভারতী স্থাপনের প্রথম আভাস পাই । কবি লিখেছেন - 'শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে -ঐখানে
সার্বজাতির মনুষ্যত্বচর্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে -স্বাজাতির সংকীর্ণতার যুগ শেষ
হয়ে আসছে -ভবিষ্যতের জন্যে যে বিশ্বজাতিক মহামিলনযজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তার প্রথম
আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে ।' এই ভাবনার কয়েক বৎসর পরে কবি আশ্রমের তরুণ শিক্ষক সুহৃৎকুমার
মুখোপাধ্যায়কে লেখেন, 'ভারতের একটা জায়গা থেকে ভূগোল বিভাগের মায়াগণ্ডী সম্পূর্ণ
মুছে যাক - সেইখানে সমস্ত পৃথিবীর পূর্ণ অধিষ্ঠান হোক - সেই জায়গা হোক আমাদের শান্তিনিকেতন
।'
|
Logo of Bishwavarati |
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
শেষ হল ১১ নভেম্বর ১৯১৮ সালে । তার এক
মাস পরে শান্তিনিকেতনে নিভৃতে মুষ্টিমেয় সমদরদি লোকদের নিয়ে শান্তিবাদ ও বিশ্বমৈত্রীর
প্রতীক বিশ্বভারতীর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হল (ডিসেম্বর ২৩,১৯১৮ :
৮ই পৌষ ১৩২৫)। কবির সৃজ্যমানস (creative
mind) যে শুধু সাহিত্য বিষয়ে নব নব সৃষ্টি করে চলে তা নয়, শিক্ষাবিষয়েও
তা সম্প্রসারী । ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আঠারো বৎসর পূর্ণ
হয়েছে, কবির মনে হচ্ছে শান্তিনিকেতনের জন্য
কিছু করণীয় আছে । প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে রবীন্দ্রনাথ
দ্বিতীয় বার ইউরোপে যান, ইউরোপ থেকে
প্রত্যাগমন করে কবি বিশ্বভারতীকে সাধারণের হাতে উৎসর্গ করবার জন্য সভা আহ্বান করলেন
(১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর), সেই সভার
সভাপতি ছিলেন আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল । সেদিনকার
ভাষণে আচার্য বিশ্বভারতীর মর্মার্থটি অতি সুন্দরভাবে বললেন । তিনি বললেন
যে, "বিশ্বভারতীর আক্ষরিক অর্থের দ্বারা
আমরা বুঝি যে, 'ভারতী' এতদিন অলক্ষিত
হয়ে কাজ করছিল, আজ তিনি প্রকট হলেন । কিন্তু
এর মধ্যে আর-একটি ধ্বনিগত অর্থ আছে -বিশ্ব ভারতের কাছে এসে পৌছাবে, সেই বিশ্বকে
ভারতীয় করে নিয়ে আমাদের রক্তরাগে অনুরঞ্জিত করে, ভারতের
মহাপ্রাণে অনুপ্রাণিত করে আবার সেই প্রাণকে বিশ্বের কাছে উপস্থাপিত করব । সেই ভাবেই
বিশ্বভারতীর নামের সার্থকতা আছে ।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comments. Please visit again.