Welcome to my Blog

Saturday, 29 June 2013

খুকু ও কাঠ্‌বেরালি/khuku o kathberali

খুকু ও কাঠ্‌বেরালি
কাজী নজরুল ইসলাম

কাঠ্‌বেরালি ! কাঠ্‌বেরালি ! পেয়ারা তুমি খাও ?
গুড়-মুড়ি খাওদুধ-ভাত খাওবাতাবি নেবুলাউ ?
বেড়াল-বাচ্চাকুকুর ছানাতাও ? -
ডাইনী তুমি হোঁৎকা পেডুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক !
বাতাবি নেবু সকলগুলো
এক্‌লা খেলে ডুবিয়ে নুলো !
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস্ পাটুস্ চাও ?
ছোঁচা তুমি ! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার  ! যাও !

কাঠ্‌বেরালি !  বাঁদ্‌রীমুখী !  মার্‌বো ছুঁড়ে কিল ?
দেখ্‌বি তবেরাঙাদা'কে ডাক্‌বোদেবে ঢিল !
পেয়ারা দেবেযা তুই ওঁচা !
তাইতো তোর নাকটি বোঁচা !
হুত্‌মো চোখী ! গাপুস্-গুপুস্
এক্‌লাই খাও হাপুস্-হুপুস্ !
পেটে তোমার পিলে হবে ! কুড়ি-কৃষ্টি মুখে !
হেই ভগবান   একটা পোকা যাস্‌ পেটে ওর ঢুকে !
ইস্ !  খেয়োনা মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও !
আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে !  একটি আমায় দাও !

কাঠ্‌বেরালি !  তুমি আমার ছোড়দি' হবে  ?  বৌদি হবেহু !
রাঙা দিদিতবে একটা পেয়ারা দাওনা !  উঃ !
এ রাম !  তুমি ন্যাংটা পুঁটো ?
ফ্রক্‌টা নেবেজামা দুটো ?
আর খেয়োনা পেয়ারা তবে,
বাতাবি নেবুও ছাড়্‌তে হবে !
দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ যে ছুট'মা দেখে যাও ! -
কাঠ্‌বিরিলি !  তুমি মর !  তুমি কচু খাও !!

Friday, 28 June 2013

লোকসংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথ/Robindranath

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


               পরাধীন ভারতবর্ষের শিক্ষিত ভদ্রশ্রেণি দেশের বৃহত্তম লোকসমাজ থেকে ক্রমেই দুরে সরে এলেন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটলেও দেশ তাদের কাছে অপরিচিতই রয়ে গেল এত দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতার ফলে দেশের মধ্যে যে ব্যাপক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য দেখা দিল, নিজস্ব সম্পদের প্রতি মমত্ববোধের যে অভাব ও উপেক্ষা দেখা দিল, - রবীন্দ্রনাথই প্রথম সচেতনভাবে তা প্রকাশ করলেন রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি ঘটেছিল, কেন না দেশ ও সমাজকে তিনি দূর থেকে দেখেন নি, দেখেছিলেন মর্মমূলে প্রবেশ করে রবীন্দ্রনাথ বাংলার গ্রামীণ লোকজীবনকে অন্তরঙ্গভাবে জানতেন এই গ্রাম সমাজকেই তিনি ভালোবেসেছিলেন, কেন না দেশ অর্থে তিনি বুঝেছিলেন গ্রামীণ ভারতবর্ষকে, আর দেশবাসী বলতে বুঝেছিলেন এইসব নিরক্ষর দৈবনির্ভর অন্নহীন, স্বাস্থ্যহীন গ্রমবাসীকে ঘনিষ্ঠ সাহচার্য ও মানবিক বেদনাবোধ থেকেই এই ভালোবাসা জন্মেছিল রবীন্দ্রনাথ গ্রামসমাজকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, ভালোবেসেছেন, - আর সঙ্গত কারণেই সেই গ্রামীণ লোকসমাজের সংস্কৃতিকেও আপন ঐতিহ্যের মধ্যে গ্রহণ করেছেন

                 লোকসাহিত্যের ঢিলেঢালা উন্মুক্ত উদার প্রান্তে রবীন্দ্রনাথ বিচরণ করেছেন মহৎ চিরায়ত সাহিত্য কোনো অবস্থাতেই লোক-এতিহ্যকে অস্বীকার করতে পারে না রবীন্দ্রসাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয় রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, লোকসাহিত্যের মতো স্বদেশি জিনিস আর নেই তাঁর বিপুল সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে আমরা লোক-ঐতিহ্যের অসংখ্য উপাদান লক্ষ্য করি রবীন্দ্রনাথের লেখা 'বালক ' কবিতায় কবি তাঁর ছেলেবেলার মানসিকতা প্রকাশ করেছেন লোকসাহিত্যের ভাবনাই এর মধ্যে বিবৃত হয়েছে 'রাজপুত্তুর ' -এ লিখেছেন পৃথিবীতে আর সকলে টাকা খুঁজছে, নাম খুঁজছে, আরাম খুঁজছে - আর, যে আমাদের রাজপুত্তুর সে দৈত্যপুরী থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে বেরিয়েছে তুফান উঠল, নৌকো মিলল না, তবু সে পথ খুঁজছে এটিই হচ্ছে মানুষের সব গোড়াকার রূপকথা আর সবশেষের পৃথিবীতে যারা নতুন জন্মেছে দিদিমার কাছ থেকে তাদের এই চিরকালের খবরটি পাওয়া চাই যে, রাজকন্যা বন্দিনি, সমুদ্র দুর্গম, দৈত্য দুর্জয়, আর ছোট্ট রাজকুমার একলা দাঁড়িয়ে পণ করছে -'বন্দিনিকে উদ্ধার করে আনব ' 'ছিন্নপত্রাবলী 'র ১৮০ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলার এই অনুভুতির কথা আবার প্রকাশ করেছেন ' জ্যোৎস্নারাতে যখন চরে বেড়ান তখন তিনকড়ি দাসীর কথা তাঁর মনে পড়ে ' ১২৯০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসের  ভারতী পত্রিকায় 'বাউলের গান ' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন লোকসাহিত্য সম্পর্কে সচেতনভাবে লেখা রবীন্দ্রনাথের এটিই প্রথম প্রবন্ধ সন্ধ্যাসংগীত-এর ঠিক পরেই প্রভাতসংগীত রচনাকালে কবি যখন নিজের স্বাতন্ত্র ও কাব্যভাষা খুঁজে পেয়েছেন, এই লেখাটি সেই সময়ের এই প্রবন্ধে একটি বিষয়ে কবি যে মন্তব্য করেছেন  তা তাঁর পরবর্তীকালের লোকসাহিত্য সংগ্রহ-প্রীতির পূর্বাভাস বলে মনে হয়,- 'বাঙ্গলা ভাব ও ভাবের ভাষা যতই সংগ্রহ করা যাইবে ততই যে আমাদের সাহিত্যের উপকার হইবে তাহাতে আর সন্দেহ নাই ' লোকসাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের এই বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি তাঁকে এই বিশেষ ক্ষেত্রে অমর করে রাখবে  


                রবীন্দ্রনাথ লোকসংস্কৃতির ঐতিহাসিক মূল্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, স্বদেশের চিত্তের পরিচয় লাভ করেছিলেন লোকায়ত সংস্কৃতির মাধ্যমে নিজের সাহিত্যসৃষ্টিতে যেমন লোকজীবনভিত্তিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি লোকসমাজের বিচিত্র ভাবনা ও উপকরণ তাঁর রচনা, বিশেষ করে কবিতা গান ও নাটককে বৈচিত্র্যে ও ঐশ্বর্যে ভরে তুলেছে কবির রচিত সংগীতে লোকসংগীতের সুর ও ভাবের অঙ্গাঙ্গী বন্ধনের কথাও আজ সুবেদিত গাছের শিকড়ের সঙ্গে মাটির যে সম্পর্ক, লোক-ঐতিহ্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছিল সেই সম্পর্ক এই মানসিকতার উত্তরাধিকারী হিসেবে রবীন্দ্রনাথই প্রথম ব্রাত্যজনের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরেছেন

Tuesday, 25 June 2013

Jatindranath Sengupta/ যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত

Jatindranath Sengupta (1887-1954)
               পৃথিবিকে আমরা ভালবাসি, আত্মীয় বলে মনে করি, কিন্তু কেউ কেউ তা পারে না পৃথিবীতে সবই আছে -এতো আলো, এতো আনন্দ, এত দুঃখ, এত সুখ কিন্তু এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি ? আমাকে যেদিন চলে যেতে হবে, তার পরের দিন কি কলিকাতায় ট্রাম চলবে না কিংবা আমার বারান্দার টবের গাছটিতে একটি ফুল ফুটবে না ? জানি না এইটুকু মাত্রই এঁদের অনুভূতি কিনা কিন্তু এই আত্মসমাহিত ব্যক্তি প্রিয়ার প্রেম, পুত্রের আলিঙ্গনকেও অন্তরে আসন দিতে পারেন না বাংলা সাহিত্যে দু'জন কবিকে পাই যাঁদের সম্পর্কে অনেক কথা বললেও কিছুই বলা হয় না মনে হয় তাঁরা যেন আমাদের কথার অন্তরালে মৃদু মৃদু হাসছেন এঁদের প্রথমে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এবং পরে জীবনানন্দ দাশ একমাত্র ইউরোপীয় কবি T. S. Eliot - এর সঙ্গেই এঁদের সগোত্র-আত্মীয়তা

                                               সৃষ্টির সুখে মহা খুসি যারা, তারা নর নহে , জড় ;
                                               যারা চিরদিন কেঁদে কাটাইল তারাই শ্রেষ্ঠতর
                                               মিথ্যা প্রকৃতি, মিছে আনন্দ, মিথ্যা রঙিন সুখ ;
                                               সত্য সত্য সহস্র গুণ সত্য জীবনের সুখ !
                                               সত্য সুখের আগুনে, বন্ধু, পরাণ যখন জ্বলে,
                                               তোমার হাতের সুখ-দুখ দান ফিরায়ে দিলেও চলে

          যতিন্দ্রনাথকে কি তবে নাস্তিক্যবাদী বলবেন, কেউ কেউ তাঁকে নৈরাশ্যবাদীও বলতে চান এ আসলে নৈরাশ্য বা নাস্তিক্য নয়, কবির এ এক দুর্জয় অভিমান জগৎ, জীবন, প্রেম, প্রকৃতির মধুভাণ্ড সকলই তো একটা প্রচণ্ড ফাঁকি অবশ্য ইহাদের অস্তিত্ব আছে কিন্তু কবির কাছে সবই মোহ - একটা ছলনা ছাড়া আর কি ? বঞ্চনার বিশ্বে শুষ্ককণ্ঠে চলতে চলতে সামান্য কয়বিন্দু পানীয় সংগ্রহ করে কতটুকু পিপাসা মিটতে পারে


                                                       চেরাপুঞ্জীর থেকে
                             একখানি মেঘ ধার দিতে পার গোবি-সাহারার বুকে ?

          একেবারেই সম্ভব নয় বিশ্ব 'চেরাপুঞ্জী 'ই থাকবে আর আমি 'গোবিসাহারা 'র পিপাসা নিয়ে থাকব সুতরাং এই কুহক অবলম্বন করে কবি চলতে পারে না

                                                         কে গাবে নূতন গীতা -
                                  কে ঘুচাবে এই সুখ-সন্ন্যাস -গেরুয়ার বিলাসিতা ?
                                                       কোথা সে অগ্নিবাণী -
                                 জ্বালিয়া সত্য, দেখিবে দুখের নগ্ন মূর্তিখানি !
                                                      একথা বুঝিব কবে -
                                 ধানভানা ছাড়া কোন উঁচু মানে থাকেনা ঢেকির রবে

          যতীন্দ্রনাথ তাই বাক্‌চাতুরি, ভাববিলাস, ক্লীব আধ্যাত্মিকতাকে ধিক্কার দিয়েছেন ইংরেজ কবি ডনের কবিতায় যে Metaphysical তত্ত্ব রয়েছে তা যতীন্দ্রনাথের উপর কিছুটা প্রভাব বিস্তার করে যতীন্দ্রনাথ সেই তত্ত্বের সাহায্যে একটি আত্মতত্ত্বে পৌঁছেছেন কবির কাব্যধর্মের দৃষ্টি প্রতিভাত হয় তাঁর কাব্যের নামকরণে কবির কাব্যগ্রন্থ গুলি - পরীচিকা (১৯২৩), মরুশিখা (১৯২৭), মরুমায়া (১৯৩০), সায়াম্ (১৯৪০), ত্রিযম (১৯৪৮) ও নিশান্তিকা (১৯৫৭) কবির চয়নিকা কাব্যের নাম, অনুপূর্বা (১৯৪৬)

Monday, 24 June 2013

লিচু চোর /Lichu chor

                          লিচু-চোর   

                                     (নজরুল ইসলাম )



বাবুদের তাল-পুকুরে  /  হাবুদের ডাল্-কুকুরে  /  সে কি বাস্ কর্‌লে তাড়া  / 

বলি থাম্ ,একটু দাঁড়া !  /  পুকুরের ঐ কাছে না  /  লিচুর এক গাছ আছে না  /

হোথা না আস্তে গিয়ে  / য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে  /  গাছে গ্যে' যেই চ'ড়েছি  /

ছোট এক ডাল ধরে'ছি  /  ও বাবা মড়াৎ ক'রে  /  প'ড়েছি সড়াৎ জোরে  /

পড়্‌বি পড়্ মালীর ঘাড়েই,  /  সে ছিল গাছের আড়েই  /  ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,  /

ধুমাধুম গোটা দুচ্চার  /  দিলে খুব কিল ও ঘুসি  /  একদম জোর্‌সে ঠুসি !  /

আমিও বাগিয়ে থাপড়  /  দে হাওয়া চাগিয়ে কাপড়  /  লাফিয়ে ডিঙ্‌নু দেয়াল,  /

দেখি এক ভিট্‌রে শেয়াল !  /  আরে ধ্যাৎ শেয়াল কোথা ?  /  ডেলোটা দাঁড়িয়ে হোতা  /

দেখে যেই আঁৎকে ওঠা  /  কুকুরও জুড়্‌লে ছোটা !  /  আমি কই কম্ম কাবার  /

কুকুরেই করবে সাবাড় !  /  " বাবা গো মাগো " বলে /  পাঁচিলের ফোঁকল গলে   /

ঢুকি গ্যে বোস্‌দের ঘরে   /  যেন প্রাণ আস্‌লো ধড়ে !  /  যাব ফের ? কান মলি ভাই,  /

চুরিতে আর যদি যাই !  /  তবে মোর নামই মিছা !  /  কুকুরের চাম্‌ড়া খিঁচা  /

সে কি ভাই যায়রে ভুলো -  /  মালীর ঐ পিট্‌নী গুলো !  /  কি বলিস ? ফের হপ্তা ?  /

                                         তৌবা - নাক খপ্‌তা !   

রথযাত্রা/Ratha yatra


রথযাত্রা
                মানুষের শরীরটাই যেন একটা রথ আমরা দেখি, কঠোপনিষদে সেই রথের এক অপূর্ব বর্ণনা আমাদের শরীর-রূপ রথখানি বিজয়পথে অবিরাম ছুটে চলেছে মানবদেহের ইন্দ্রিয়গুলি হচ্ছে এই রথের ধাবমান ঘোড়া আমাদের বুদ্ধি-রূপ সারথি, জন-রূপ লাগাম জুড়ে দিয়ে ইন্দ্রিয়-রূপ ধাবমান ঘোড়াগুলির গতিকে সবলে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে আর সেই রথের অধিপতি হচ্ছে আত্মা, যা কিনা অচঞ্চল শান্ত মূর্তিতে রথোপরি বিরাজিত, রথের গতিবেগ তাঁকে আদৌ স্পর্শ করছে না অনেক পন্ডিত মনে করেন শ্রীশ্রীজগন্নাথকে নিয়ে এই রথযাত্রা উৎসব ওই চিরন্তন আধ্যাত্মিক আদর্শকেই সর্বজনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এক লৌকিক আয়োজন জনসমষ্টি নিয়েই জগৎ এবং সেই জনগণের অধিনায়ক হচ্ছে প্রভু জগন্নাথ জগন্নাথ স্বামী "অঙ্গুষ্ঠ মাত্রঃ পুরুষঃ " রূপে সকলের মধ্যে রয়েছেন অনন্তকালের এই বিশ্বাস পোষণ করেই ভক্তরা মনি করেন, তাঁকে জানলে ও বুঝলে আর পুনর্জন্ম হয় না

              জগন্নাথের রথযাত্রা উৎসব, যার মধ্যে দেবতা ও মানুষের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক যেমন বিকশিত, তেমনি ভক্ত ও ভগবানের চিরন্তন ভালোবাসার সম্পর্কটিও প্রকাশিত জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম এই তিন দেবতা তাদের রত্ন-সিংহাসন থেকে নেমে আসেন পথের ধূলায়, নেমে আসেন সর্বজনের মাঝে, ধরা দেন শ্রেণীহীন,বর্ণহীন এক বিশাল জনগোষ্ঠির হাতে এবং এভাবেই দেব মহিমায় অভিষিক্ত হয় মানব মহিমা পুরীর রথযাত্রা ভারতীয় ধর্মজীবনের এক অতি প্রাচিন উৎসব প্রকৃতপক্ষে পুরীর পরই আমরা মাহেষের বিখ্যাত রথ যাত্রার কথা স্মরণ করতে পারি এছাড়াও মহিষাদলের রথযাত্রা, চন্দনদগরের রথযাত্রা এবং সাম্প্রতিক ইস্কনের রথযাত্রা বা উল্টোডাঙ্গার রাইকানু ভাগবত সমাজের জনপ্রিয় রথযাত্রার কথাও উল্লেখ করতে পারি এই তালিকা অনায়াসেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা য়ায় কারণ, বাঙালীর জীবনে দোল-দুর্গোৎসব প্রভৃতির মতো রথযাত্রাও বাস্তব অর্থে গণউৎসব
পুরীর রথ
              আমরা বলে থাকি জগন্নাথদেবের মন্দির কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি তাই ? কারণ, মন্দিরের রত্নবেদীতে শ্রীশ্রীজগন্নাথ একা অবস্থান করে না তাঁর সঙ্গে অবস্থান করেন বলাম, সভুদ্রা ও সুদর্শন চক্র এক সঙ্গে চারজনেরই পুজো হয় হিন্দু ধর্মের চারবর্ণের প্রতিক এই চারজন বলরাম বা ব্রহ্মভদ্রের গায়ের রং শ্বেতবর্ণ- তিনি ব্রাহ্মণ দেবী সুভদ্রার বর্ণ পীত, তিনি ধারণ করেছেন বৈশদের প্রতীক শ্রীশ্রীজগন্নাথের গাত্রবর্ণ গাঢ়নীল বা কালো অথাৎ, তিনি শূদ্রদের প্রতীক ধারণ করেছেন আর রক্তবর্ণ সুদর্শন চক্র ক্ষত্রিয় প্রতীক পুরীধামে জগন্নাথদেব যে রথে আরেহণ করেন, তাকে বলা হয় 'নান্দীঘোষের রথ ', রথের সারথি মাতলি শীর্ষদেশে থাকে একটি চক্র এবং চক্রের উপর দিকে শোভিত থাকে গড়ুর ও একটি বর্ণাঢ্য বিরাট পতাকা বলরামের রথের নাম 'তালধ্বজ ',রথের সারথি সুদ্যুন্ম সুভদ্রার রথের নাম 'দেবীরথ বা দর্পদলন ',এর সারথি অর্জুন প্রতি বছর মাঘ মাসের বসন্ত-পঞ্চমী তিথিতে এই তিনটি রথের জন্য কাঠ সংগ্রহ শুরু হয় আর অক্ষয় তৃতীয়ায় রথ তৈরির কাজ শুরু হয় এইভাবে প্রতিবছর তিনটি রথ তৈরি করা হয়
জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা
              জগন্নাথের এমন অসমাপ্ত রূপ কেন ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কয়েকটি পৌরাণিক কাহিনীর সন্ধান পাওয়া য়ায় সেগুলির মধ্যে প্রচলিত একটি হল উল্লেখ করা হল সেকালে মালব দেশের মধ্যবর্তী অবন্তিনগরের রাজা ছিলেন পুন্যবান ইন্দ্রদ্যুম্ন তিনি ছিলেন শ্রীবিষ্ণুর পরম ভক্ত ইনিই পুরীর মন্দির প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন একদিন রাজা সপ্নাদেশ পেলেন, প্রভাতে পুরীর সমুদ্রতীরে চক্রতীর্থে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম শোভিত দারুব্রহ্মের সাক্ষাৎ পাওয়া য়াবে তার মানে, সমুদ্রের স্রোতে ভেসে আসবে পবিত্র একটি কাঠ সমুদ্রে ভেসে আসা সেই দারুব্রহ্মকে রাজা যেন ভক্তিভরে মন্দিরে নিয়ে আসেন তবেই তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হবে যথাসময়ে রাজা দারুব্রহ্মের সাক্ষাৎ পেলেন এবং তা মন্দিরে নিয়ে এলেন সেই সময় হঠাৎই এক বৃদ্ধ শিল্পী এসে রাজদরবারে উপস্থিত হলেন ইনি স্বেচ্ছায় মূর্তি তৈরির দায়িত্ব নিতে চান এই বৃদ্ধ শিল্পীই যে ছদ্মবেশী বিশ্বকর্মা (মতান্তরে স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু )- সেটা রাজা বুঝতে পারেননি রাজা অপরিচিত এই বৃদ্ধ শিল্পীর হাতে মূর্তি তৈরির দায়িত্ব তুলে দিলেন কিন্তু বৃদ্ধ শিল্পীর শর্ত মূর্তি তৈরির কাজ শুরু হওয়ার পর একশ দিন অতিক্রম হওয়ার আগে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দরজা খুলতে পারবেন না, এবং শিল্পী নিজের মনে বন্ধ ঘরে ওই সময় কাজ করবেন

                রাজা গভীর আগ্রহে বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন এবং দেখতে দেখতে পনেরদিন অতিক্রন্ত হয়ে গেল হঠাৎ রাজা লক্ষ্য করলেন, বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে আর কোন শব্দ আসছে না তিনি রীতিমত অধৈর্য হয়ে পড়লেন শেষ পর্যন্ত মন্ত্রীদের শত অনুরোধ উপেক্ষা করে জোর করে দরজা খুলে মন্দিরে ঢুকে পড়লেন কিন্তু কোথায় সেই শিল্পী -তিনি অদৃশ্য   মন্দিরে বিরাজ করছেন তিনটি অসমাপ্ত মূর্তি এবার রাজা বুঝলেন, ওই শিল্পী স্বয়ং দেবতা ছিলেন নিজ কৃতকর্মের জন্য তিনিঅনুতাপে ভেঙ্গে পড়লেন শেষপর্যন্ত অপরাধের শাস্তি হিসাবে আত্মবিসর্জনের দৃঢ় সংকল্প নিলেন সেই রাতেই তিনি আবার সপ্নাদেশ পেলেন - "আত্মহত্যা মহাপাপ, এটা তোমাকে মানায় না তুমি ওই তিনটি অসমাপ্ত বিগ্রহকেই যথা নিয়মে পূজা কর " সেই থেকেই অসমাপ্ত রূপে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা পুরীতে পূজিত হয়ে আসছেন