kobiganer asar |
১৭৬০ থেকে ১৮৩০ এর মধ্যে কবি গানের বিকাশ
ঘটেছিল । সুনির্দিষ্ট
ভাবে বলতে গেলে বলা য়ায়, ভারতচন্দ্র রায় গুনাকরের
মৃত্যুর (১৭৬০) পর থেকে ঈশ্বরগুপ্তের মৃত্যু পর্যন্ত (১৮৫৯) একশ বছর ধরে কলকাতা ও পার্শ্বসর্তী
অঞ্চলে যে নাগরিক লোকসঙ্গীতের বিকাশ হয়েছিল তাই সাধারণ ভাবে কবিগান হিসাবে পরিচিত । কবিগানের
গায়কেরা পরিচিতি লাভ করে কবিওয়ালা বা কবিয়াল হিসাবে । কবিগান
আসলে ছিল কবিয়ালদের গানের লড়াই ।
কবিয়ালরা
দুদলে বিভক্ত হয়ে আসরে দাঁড়িয়ে বিশেষ রীতি পদ্ধতি অবলম্বন করে গান গাইতেন । এগুলি
মহড়া,
চিতেন, পরচিতেন, মেলতা,
ফুকা, মাদ ইত্যাদি নামে পরিচিত । কবিগান
নামটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হলেও তরজা, খেউড়,
আখড়াই, হাফাখড়াই, পাঁচালি
প্রভৃতি হল কবিগানের নানাবিধ আঙ্গিক । কবিতা
হিসাবে এগুলিকে মোটামুটি এক শ্রেণীভুক্ত বলে মনে করা হয় । তবে
এই আঙ্গিকগত বৈচিত্র্যের মূলে কাজ করেছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিশেষ প্রভাব । কবিগান
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল অর্ধশিক্ষিত, কোথাও
বা অশিক্ষিত গায়কের গান ।
কবিগানের
আঙ্গিকগত বৈচিত্র যেমন লক্ষ্য করা য়ায়, তেমনি
এর বিষয় গত বৈচিত্র্যও কম নয় ।
নানা
ধরনের পৌরাণিক ও ভক্তিমূলক বিষয় নিয়ে যেমন কবিগানে বিতর্ক হত,
তেমন নানা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গও কবিগানের লড়াইয়ে প্রবেশ করত । এই
সমস্ত বিষয় গুলির মধ্যেই কবিয়ালদের ভাষানৈপুণ্য, বাকচাতুর্য ও বুদ্ধিদীপ্তির প্রকাশ ঘটত । তবে
এই বাকচাতুর্য ও ভাষানৈপুণ্য স্থুলতা বর্জিত ছিল না । আসরে
দাঁড়িয়ে যাঁরা প্রয়োজন মতো গান রচনা করতে পারতেন তাঁদের বলা হত দাঁড়কবি ।
কবিগানের চারটি উপচ্ছেদ লক্ষ্য করা য়ায়,
যেমন - ভবানী বিষয়ক, সখী সংবাদ, বিরহ ও খেউড় দুদল কবিয়াল আসরে অবতীর্ণ হয়ে পর্যায়ক্রমে চারটি স্তরে সঙ্গীত
প্রতিযোগিতা ভাগ করে নিতেন ।
ভবানী
অথাৎ শ্যামা বিষয়ক, সখী সংবাদ ও বিরহ বৈষ্ণব
পদাবলীর ঢঙে রচিত হতো ।
খেউড়
গান যা অনুষ্ঠানের শেষে গাইতে হত তার অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল অশ্লীল রঙ্গ কৌতুক ও ব্যক্তিগত
গালি-গালাজ । খিউড়
তুলনামূলক ভাবে সহনীয় হলেও, কাঁচা খেউড় ছিল অতিরিক্ত
অশ্লীল ও কুরুচিকর ।
কবিয়ালরা
কিন্তু পৌরাণিক ঘটনা নিয়ে গান বাঁধতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন । তাঁদের
বেতনভুক বাঁধনদার ছিলেন যারা আসরে বসেই গান বেঁধে দিতেন এবং কবিয়ালরা সেইগান সুরে-তালে
গাইতেন । পুরাতন
কবিয়ালদের বিশেষ কোনো পরিচয় পাওয়া য়ায়নি ।
সেক্ষেত্রে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন কবি ঈশ্বরগুপ্ত, তিনি 'সংবাদ প্রভাকর'এ বহু কবিয়ালদের
পরিচয় ও কবিগানের নমুনা মুদ্রিত করেছেন । তানাহলে
এই কবিয়ালরা স্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যেতেন । ভবানীবেনে,
রাসু, নৃসিংহ, হরণঠাকুর,
নিতাই বৈরাগী, রামবসু,ভোলা
ময়রা, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী প্রভৃতি কবিয়াল উনিশ শতকে কলকাতা ও
শহরতলীকে মাতিয়ে রেখেছিলেন ।
এরা
প্রায় সকলেই কমবেশী প্রতিভাবান ছিলেন ।
তারপর
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সাহিত্য, সমাজ,
শিক্ষাদীক্ষা, ধর্ম প্রভৃতি ক্ষেত্রে নবযুগের আবির্ভাব
হলে নাগরিক কবিগান ক্রমশ গ্রামীণ সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে ওঠে । বর্তমানে
কবিগান যতই বিলুপ্ত হয়ে যাক না কেন এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম ।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your comments. Please visit again.